Header Ads

Header ADS

সুফি ঘূর্ণন নৃত্য শুরু হয়েছিলো যেভাবে


পা পর্যন্ত লম্বা শাদা আলখেল্লা, মাথায় লম্বা টুপি, কোমরে কাপড় দিয়ে পেঁচানো বন্ধনী, উপরে মানানসই কোটি পরে ধীরপায়ে কিছু মানুষ হেঁটে এলেন। এক খেয়ালে তাকিয়ে থাকলে যেন মনে হয় প্রত্যেকের দেহ থেকে স্বর্গীয় দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তারা সবাই প্রেমিক। একজন প্রেমিক অন্য একজন প্রেমিকের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বললেন। অন্যজন স্মিত হেসে চোখের ভাষার জবাব দিলেন। কী কথা হলো চোখে আর হাসিতে কেউ তা বুঝলো না। এরপর তারা একটি কেন্দ্র তৈরি করে তার চারদিকে বৃত্তাকারে হাঁটতে লাগলেন, যেন এখনই কবর থেকে উঠে এসেছে কিছু পবিত্র আত্মা, যেন তাদের মোলায়েম পদযুগলে আকাশের নীরবতা মাটিতে নেমে আসছে। অতঃপর তারা কল্পিত বৃত্তের পরিধি বরাবর ঘুরতে লাগলেন। এভাবে ঘূর্ণনের ফলে প্রেমিকদের নৃত্য সর্পিলাকারে মহাজাগতিক ছন্দের আকার ধারণ করলো। কিছুক্ষণ পর দুই হাত আড়াআড়িভাবে উপরে তুলে নিজের অক্ষ বরাবর ঘুরতে থাকলেন। এর সাথে মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত অথবা জিকিরের সুর এসে হৃদপিণ্ডে মিশে যেতে থাকলো। এই নৃত্য আমরা সবাই দেখেছি, যা সুফি নৃত্য বা সুফিদের ঘূর্ণন নৃত্য নামে পরিচিত। কোথাও কোথাও সেমা নৃত্য নামেও পরিচিত।


মাওলানা জালাল-উদ্দীন রুমি এই নৃত্যের প্রবর্তক। তিনি মনে করতেন সঙ্গীত এবং নৃত্যের মাধ্যমে প্রেমের পথে দিশা পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, বিশেষতঃ তুরস্কে।

সুফি ঘূর্ণন নৃত্যের শুরু হয়েছিলো প্রায় আটশ' বছর আগে কোনিয়ার এক বাগানে। শামস তাবরিজির মৃত্যুর সংবাদ শুনে মাওলানা রুমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। কেউ এসে তাকে বলেন শামস তাবরিজিকে খুন করা হয়েছে, কেউ এসে বলেন শামস তাবরিজি নিহত হন নি, যদি খুন করা হয়ে থাকে তাহলে তার লাশ কোথায়? কেউ এসে বলে শামস তাবরিজি হঠাৎ শূন্যে মিলিয়ে গেছেন, এরপর কেউ তাকে দেখেনি। প্রতিটি সংবাদ মাওলানাকে ব্যথিত করলো। তিনি তার বুক খোলা শাদা আলখেল্লা পোশাকটি পরিধান করলেন। মাথায় দিলেন লম্বা বাদামি টুপি। পায়ে অমসৃণ নিচু স্যান্ডেল। ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে যেতে লাগলেন বাগানের দিকে। তার ছাত্র-বন্ধুরা পেছন থেকে ডাকলো। কিন্তু তিনি সাড়া পেলো না কেউ, যেন তাদের কথা মাওলানার কান পর্যন্ত যাচ্ছেই না। মাওলানা বাগানে গেলেন। বাগানের একটা খুটি ধরে ঘুরতে শুরু করলেন। ঘুরছেন তো ঘুরছেন, যেন এর কোন শেষ নেই। কখনো মুখে অস্ফুটস্বরে দুই একটা শব্দ বা বাক্যাংশ বুঝা যাচ্ছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তিনি ঘুরতে থাকলেন অবিরাম। কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় তিনি এভাবে একটানা চল্লিশ দিন ঘুরতে থাকেন। আবার কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় শামস তাবরিজির মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার চল্লিশতম দিনে তিনি এই ঘূর্ণন শুরু করেছিলেন, তবে শেষ করেছিলেন কবে তা জানা যায় না। মূলতঃ এভাবেই সুফি ঘূর্ণন নৃত্যের সূচনা হয়। এরপর মাওলানা রুমির শিষ্যদের মাধ্যমে তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পাক-ভারত উপমহাদেশেও আমরা এর প্রচলন দেখতে পাই, বিশেষ করে মোঘল আমলে এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। আধুনিক বাংলাদেশে কিছু 'নৃত্যশিল্পী' নাচের প্রকরণ হিসেবে এই নৃত্য শিখেন এবং প্রদর্শন করে থাকেন। সুফি ঘূর্ণন নৃত্যের মাহাত্ম্য অঙ্গ সঞ্চালন-প্রসারণের সাথে জড়িত নয়। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে, মহাবিশ্বের স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা সৃষ্টির সৌন্দর্যকে হৃদয়ে অনুভব করার মাধ্যমে এক মহাজাগতিক সম্পর্কের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা হলো এই নৃত্য। সমস্ত কল্পনাকে এক সুঁতায় গেঁথে শরীর ও মনকে পরম শক্তির কেন্দ্রবিন্দুর কাছে সমর্পিত করার মাধ্যমে যে আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়, তা কি নৃত্যশিল্পীর অঙ্গের কসরতে মিলবে?

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, এস খলিলুল্লাহর অনুবাদকৃত দিওয়ান-ই-শামস-ই তাবরিজির ভূমিকাংশ (ইরা ফ্রিডল্যান্ডারের ভূমিকা), এন্ড্রু হার্ভের "রাগমার্গ", মাওলানা আব্দুল মজীদের অনুবাদকৃত মসনবীয়ে রুমির ভূমিকাংশ ইত্যাদি।


লেখকঃ আমির আব্দুল্লাহ 

1 টি মন্তব্য:

  1. আমার মন্তব্য এটাই যে এটিকে আমি একটি আপ বা অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে পেতে চাই।
    অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে হলে আমার খুব ভালো হবে।

    উত্তরমুছুন

rusm থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.