শাহ নেয়ামতুল্লাহর ক্বাসিদা ও ব্যাখ্যা (পর্ব-৩)
শাহ নেয়ামতুল্লাহ সপ্তদশ শতকে গৌড় অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে পরিচিত। ফার্সি ভাষায় লেখা তার ক্বাসিদা বা বড় কবিতাটি ইতিহাসে অমরত্বলাভ করেছে নির্ভুল ভবিষ্যতবানী করার জন্য। কবিতায় বলা প্রতিটি বানী হুবুহু মিলে যাচ্ছে। আমরা স্পিরিচুয়াল পোয়েট্রি হিসেবে ধারাবাহিকভাবে ক্বাসিদা নিয়ে আলোচনা করছি। আজ পড়ুন এর তৃতীয় পর্বঃ
দ্বিতীয় পর্ব দেখুনঃ শাহ নেয়ামতুল্লাহর ক্বাসিদা ও ব্যাখ্যা (পর্ব-২)
কবিতার এই অংশে এসে শাহ নেয়ামতুল্লাহর করুন আর্তনাদ উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তিনি নিজের কলিজার রক্ত পান করা বলতে নিজের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বুঝিয়েছেন। তিনি মুসলমানদের আহবান করছেন অশ্লীলতা, নগ্নতা, শঠতা থেকে বেরিয়ে আসতে। নইলে কঠোর শাস্তি নেমে আসবে তাদের উপর। তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। মুসলমানদের জীবন-সম্পদ সবকিছু রক্তে ভেসে যাবে। মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালে এসবের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
পাঞ্জাব কেন্দ্র বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। হতে পারে কাশ্মির বা পঞ্চ নদের বা পাঞ্জাবের অন্যান্য এলাকা মুসলিমরা দখল করে ফেলবে। সেখানকার ধন-সম্পদ মুমিনদের দখলে আসবে। এখানে এটাই লক্ষনীয় বিষয় যে তিনি মুমিন শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ যারা পাঞ্জাব কেন্দ্র দখল করবে তারা হবে মুমিন। এই দখলের পিছনে অবশ্যই বৈধ কারণ থাকবে। রাজনৈতিক লিপ্সা বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কারণে কেউ যদি দখল করেও নেয় তাহলে তা এই ভবিষ্যতবানীকে সিদ্ধ করে না, কারণ এটা মুমিনের স্বভাব নয়। এরপরে বলছেন ঠিক অনুরূপ মুমিনদের একটি শহর অমুসলিমরা দখল করে ফেলবে। সেখানে এতোই হত্যা-লুণ্ঠন চালাবে যে মুসলমানদের ঘরে ঘরে কান্নার আওয়াজ শোনা যেতে থাকবে। খুবই ভয়ংকর হবে সেই দিন। যারা বলে থাকেন এটা বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদের অনুমানের কোনই ভিত্তি নেই। কারণ পাঞ্জাব এবং বাংলাদেশকে “অনুরূপ” বলার কোন কারণ নেই। পাঞ্জাব অনেক উন্নত এবং বাংলাদেশ তাদের তুলনায় গরীব। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন।
মুসলিম
বিশ্বে এই ধরনের নেতার অভাব নেই। যারা নিজের দেশের সম্পদ অন্যদেশের কাছে নিজের
ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পাচার করে দিচ্ছে। এরকমই এক মুসলিম নেতার কথা
বলছেন শাহ নেয়ামতুল্লাহ। যার গোপনে এমন এক চুক্তি করবেন যা দেশ বিক্রি করে দেওয়ার
নামান্তর হবে। এই ঘটনাগুলো ঘটবে দুই ঈদের নামের
প্রথম
অক্ষর হবে আরবি হরব শীন দিয়ে এবং নাম শেষ হবে আরবি হরফ নুন দিয়ে। সেই নেতা এসে বরং
বলা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষ ধিক্কার দেওয়া শুরু করবে জালিমদের। এভাবে সেই বছরটি
কেটে যাবে। মাঝখানে, অর্থাৎ শাওয়াল থেকে জিলহজ্ব মাসের মধ্যবর্তী কোন সময়ে। এই
চুক্তির ফলে শুধু এই অঞ্চল নয়, জন্য যুদ্ধ ঝাপিয়ে পড়বেন। এক্ষেত্রে
যারা বলেন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হলো সেই চুক্তি যার মাধ্যমে বাংলাদেশ পরের বছরের শুরুতে অর্থাৎ মহররম মাসে মুসলিমদের
হাতে অস্ত্র এসে যাবে। সেই অস্ত্র দিয়ে তারা দেশরক্ষার বিক্রি
করে
দেওয়া হয়েছে, তারা মিথ্যাবাদী। সাধারণ জনগণ তাদের এই মিথ্যা বিশ্বাস করে নিয়েছে কারণ এরকম ব্যাখ্যা
করে থাকে তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিল করা, ক্বাসিদা পাঠ করে উপকৃত শেখ মুজিবুর
রহমানের নামের প্রথমে শিন এবং শেষে নুন হরফ আছে। যদি এটাই সত্য হতো তাহলে তখনকার পরবর্তী
মহরম
মাসে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কঠিন যুদ্ধ শুরু হতো। কিন্তু তা হয় নি। সত্যি বলতে যারা হওয়া নয়।
তাদের নোংরা লিপ্সা চরিতার্থ করতে সম্মানী লোকের সম্মানহানি করে। এদের সম্পর্কে শাহ নেয়ামতুল্লাহ
পূর্বেই
সাবধান করে দিয়েছেন।
মহরম মাসে অস্ত্র পাওয়ার পর থেকেই পুরো ভারতবর্ষে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। এটাকেই সম্ভবত হাদিসে গাজওয়াতুল হিন্দ বলা হয়েছে। এই যুদ্ধে মুসলিমরা ৩ দলে ভাগ হয়ে যাবে। একদল বিশ্বাসঘাতকতা করবে, একদল শহীদ হবে এবং একদল যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। শাহ নেয়ামতুল্লাহ উসমান নামের এক বীরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এসে যুদ্ধের কঠিন শপথ নেবেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় তিনি হয়তো ভারতের বাইরে থেকে আসবেন। কিংবা এটাও হতে পারে যে তিনি এই যুদ্ধের ডামাডোল থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাবেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তিনি তার স্থান ত্যাগ করে যুদ্ধে অংশ নেবেন। এর ব্যাখ্যা আল্লাহ ভালো জানেন। পরের লাইনে সাহেবে কিরান দ্বারা একটা জন্ম-তিথি বুঝানো হয়েছে। শনি ও বৃহস্পতিগ্রহ অথবা শুক্র ও বৃহস্পতি গ্রহের একই রৈখিক কোণে অবস্থানকালীন সময়ে যার জন্ম হয়, তাকে বলা হয় সাহেবে কিরান। তার নাম হবে হাবিবুল্লাহ। তিনি হাতে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বেন। এখানে উসমান এবং হাবিবুল্লাহ নামটি সরাসরি বলা থাকতে পারে অথবা রূপক অর্থেও হতে পারে। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন। তার বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাবেন। এখানেই “সীমান্ত বীর” বলা হচ্ছে এবং তারা ভারতের দিকে আগাবেন। এরমানে তারা হয়তো ভারতের বাইরে থেকে আসবেন এবং তাই এখানে সীমান্তে যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে। শাহ নেয়ামতুল্লাহর সময় বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান তথা এই উপমহাদেশকে একসাথে ভারত বা ভারতবর্ষ বলা হতো।
পঙ্গপাল সংখ্যায় হাজার-হাজার, লাখ-লাখ একসাথে ধেয়ে আসে। এই উপমা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে সেই যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যাও হবে অসংখ্য-অগণিত। পঙ্গপাল নিজে দুর্বল হলেও সে যখন দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে তাদের সাথে শক্তিশালী মানুষও হেরে যায় ফসল রক্ষা করতে। এরকমই হয়তো অবস্থা তৈরী হবে তখন। তাদের সাথে মিলবে দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাহিনি এবং ইরান ও আফগানিস্তান থেকে আসা বাহিনি। তাদের মিলিত শক্তিতে গোটা ভারতবর্ষ জয় করে ফেলবে মুসলমানরা। শত্রুদের বরবাদ করে দেওয়া হবে বলতে বুঝানো তাদের একদম সর্বোচ্চ ধ্বংসের দিকেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সেই ধ্বংসাপ্রাপ্ত দেশ আবারও সজীব হয়ে উঠবে বলে বুঝা যায় শেষ লাইন থেকে। সেই দেশের উপর আল্লাহর রহমত নেমে আসবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটাকে আবার গড়ে তোলা হবে। পরের ভবিষ্যতবানী এখনো বুঝা যাচ্ছেনা। ইসলাম ধর্মের উপর ব্যাপক রাগ-ক্ষোভ থাকবে এমন এক ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের কথা বলা হয়েছে এখানে। তার নামে থাকবে ৬টি আরবি হরফ। প্রথম হরফটি হবে গাফ। মুমিনের হৃদয় আনন্দে ভরে যাবে। ভারত থেকে শিরকের কোন চিহ্নও আর অবশিষ্ট থাকবে না।
তথ্যসূত্রঃ কাসিদায়ে সাওগাত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত
লেখা ও ব্যাখ্যাঃ মিজানুর রহমান
কোন মন্তব্য নেই