Header Ads

Header ADS

শেখ সাদির গল্প-৩। বেঁটে ও লম্বা রাজপুত্র


এর আগের গল্প পড়ুনঃ শেখ সাদির গল্প-২| খোরাসানের বাদশাহর অদ্ভুত এক স্বপ্ন

এক বৃদ্ধ বাদশাহ সুখে-শান্তিতে রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। তার রাজ্যে মানুষ অনেক সুখে ছিলো। দেশের ফসল-ফলাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুই ভালোভাবে চলছিলো। তবে বাদশাহর মনে শুধু একটিই দুঃখ। আল্লাহ তাকে বেশ কয়েকজন বলবান পুত্র এবং সুশ্রী কন্যা দান করেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন পুত্র ছিলো আকারে বেঁটে, সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। বাদশাহ ভাবতেন তার সমস্ত অপমানের কারণ এই বেঁটে পুত্রটি। লোকজন আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, গালি দেয়। বাদশাহর অক্ষমতা নিয়ে বিদ্রুপ করে। কিন্তু সেই বেঁটে রাজপুত্র ছিলেন প্রচন্ড জ্ঞানী এবং সাহসী। পড়াশোনা এবং সততায় সে ছিলো অন্য সকল ভাইয়ের চেয়ে উত্তম। কিন্তু সে তার বাবার দুঃখের কথা জানতো। কিন্তু সে কোন ভাবেই এই দুঃখ দূর করার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না।

একদিন রাজদরবারে সেই রাজপুত্র সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, “পবিত্র শরীয়াহ অনুযায়ী ছাগল হালাল, কিন্তু হাতি হারাম। এটা যথার্থ নয় যে কেউ আকৃতিতে বড় হলেই তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বয়ং প্রমাণিত হয়ে যায়। বিরাট গাছের চেয়ে ঔষধি গুল্ম অধিক উপকারী নয় কি?” এরপর সে তার বাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “নির্বোধ যতই দীর্ঘকায় হোক না কেনো, জ্ঞানী বেঁটের মাহাত্ম্যই বেশি। জ্ঞানী হওয়ার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন, লম্বা দেহের নয়।”

বাদশাহ তার পুত্রের বক্তব্য নৈপুণ্যতায় প্রচন্ড খুশি হয়ে গেলেন। তার মনের যাতনা অনেকাংশে দূর হয়ে গেলো। উপস্থিত সভাসদেরা রাজপুত্রের প্রজ্ঞা দেখে বাহবা দিতে লাগলেন। সভায় বেঁটে রাজপুত্রের জয়জয়কার ধ্বনি উচ্চারিত হতে লাগলো। এতে তার বোনেরা খুশি হলেও অন্যান্য ভাইয়েরা প্রচন্ড কষ্ট পেলো। তারা একইসাথে ভয় পেয়ে গেলো এই ভেবে যে, তাদের পিতা না জানি বেঁটে পুত্রকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ফেলেন।
তাদের একজন সভার কোলাহল ধ্বনি থামিয়ে বক্তব্য দেয়া শুরু করলো, “হে প্রিয় ভাই আমার”, সবাই তার দিকে তাকালো, এরপর সে বলতে থাকলো, “তোমার আকৃতি ছোট হলেও কণ্ঠ কিন্তু অনেক বড়। এরচেয়ে তুমি এমন কিছু করে দেখাও যা তোমার যোগ্যতা সিদ্ধ করবে।”

বেঁটে রাজকুমার বললেন, “আরবি ঘোড়া যদিও ক্ষীণকায়, কিন্তু মোটা-তাজা ঘোড়ার চেয়ে তারা উত্তম। প্রিয় ভাই ঘোড়ার মাহাত্ম্য যুদ্ধের ময়দানেই বুঝা যায়, বাগানে নয়।"

বাদশাহর অন্তরে আবারও ভয়ের চিন্তা রেখাপাত করলো। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন তার পুত্রদের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন।

এর কিছুদিন পরের কথা। ওই রাজ্যের উপর শত্রুরা আক্রমণ করলো। তারা ছিলো সংখ্যায় বিপুল, যুদ্ধে নিপুণ, সাহসে বলীয়ান। শান্তির রাজ্যে ঘোর বিপদ আসন্ন। বৃদ্ধ রাজা তার পুত্রদের দেশ রক্ষায় পাঠিয়ে দিলেন। তারা সবাই নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে রওনা দিলো। শত্রুপক্ষের অসীম ক্ষমতার কথা জানতে পেরে সুদর্শন পুত্ররা যুদ্ধ করতে অনীহা দেখাতে শুরু করলো। তারা চাচ্ছিলো যেকোনো ভাবে এই যুদ্ধে না জড়াতে। অপরদিকে বেঁটে রাজকুমার তার সেনাদের অন্তরে তীব্র দেশপ্রেম ও সাহস সঞ্চারিত করে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্যত হলো।

সে তার সেনাদের বললো, “আমি ওই কাপুরুষ নই, যে কী না শত্রুদের পিঠ দেখাবে। আমার মাথা সবসময় মাটিতে এবং রক্ত সাগরে মিশে থাকে। তাই যে আমার সাথে যুদ্ধ করতে আসবে, সে আমার মাথা পাবে না, রক্তও পাবে না, তার মৃত্যু অবধারিত।” এরপর সে তার অন্য ভাইদের দিকে তাকিয়ে বললো, “যে ব্যক্তি যুদ্ধ করতে চায় না, তাকে আমরা যুদ্ধ করতে আহবান করবো না। তারা বরং এখনই বাড়িতে ফিরে যাক এবং মহিলাদের পোশাক পরে নিরাপত্তা লাভ করুক।” রাজকুমারের তেজস্বী বক্তব্য শুনে সেনারা সাহস ফিরে পেলো। তারা বীর-বিক্রমে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে প্রথম দিনেই বিজয় ছিনিয়ে আনলো। বেঁটে রাজপুত্র একাই শত্রুপক্ষের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন যোদ্ধাকে হত্যা করেছিলো। তার এই বীরত্বের কথা দ্রুতই সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লো।

যুদ্ধ শেষে বাদশাহ এক শাহী ফরমান জারী করলেন। তিনি তার উত্তরাধিকার হিসেবে বেঁটে পুত্রকে মনোনীত করলেন। তিনি বললেন, “আমরা ক্ষীণকায় ঘোড়ার যোগ্যতার প্রমাণ পেয়েছি। এর সাথে এটাও দেখেছি যে মোটা-তাজা ঘোড়া অল্প কাজ করেই হাঁপিয়ে যায়।” এরপর সভাসদদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি আমার যোগ্য উত্তরসুরী পেয়ে গেছি। আর তোমরাও একজন যোগ্য বাদশাহ পেলে।” সভায় আবারও বেঁটে রাজপুত্রের নামে জয়ধ্বনি করা হলো। এতে তার অন্যান্য ভাইয়েরা হিংসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকলো। তারা তখনই সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই হোক এই বেঁটে ভাইকে হত্যা করতে হবে। সেদিন তারা মুখে আনুগত্য স্বীকার করলেও অন্তরে ঘৃণা নিয়ে হত্যা পরিকল্পনা চালিয়ে গেলো।

একদিন তারা একটা ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বেঁটে ভাইকে খাবারের সাথে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। এতে কেউ বুঝতে পারবে না। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ভোজ অনুষ্ঠানে তার ভাইকে দাওয়াত দিলো। ভাইদের নিমন্ত্রণ যুবরাজ সানন্দে গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানের দিন তারা সবাই একসাথে খেতে বসলো। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক শুধুমাত্র বেঁটে রাজপুত্রের  খাবারে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু পাপ গোপন রইলো না। তাদের চালাক বোন বিষ মিশানোর ঘটনা দেখে ফেললো। সে তৎক্ষণাৎ যেয়ে যুবরাজকে সব বলে দিলো। যুবরাজ অর্থাৎ বেঁটে রাজপুত্র খাবার দেখে হাসলেন, বললেন, “এটা অসম্ভব যে পৃথিবী থেকে জ্ঞানীরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে আর নির্বোধেরা বেঁচে থেকে তাদের স্থান দখল করা রাখবে।” 

তাদের হত্যা পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে বাদশাহ সব রাজকুমারকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। তারা একেক এলাকার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে আত্মকলহ বন্ধ করলো।

শেখ সাদী বলছেন, “যদি কোন দরবেশ রুটি খায়, বাকী অর্ধাংশ সে অনু দরবেশকেও দেয়। যদি কোন রাজা কোন অঞ্চলের রাজত্ব পায়, তবুও সে এর উপর সন্তুষ্ট হয় না। অন্য রাজ্য দখল করার চিন্তায় থাকে।”

এরপরে দেখুনঃ শেখ সাদির গল্প ৪

মূলঃ গুলিস্তাঁ (১ম স্বর্গ), হেকায়েত ৩
লেখাঃ শেখ সাদি
ভাবানুবাদ ও গল্প লিখনঃ মাহফিজুর রহমান


আরও দেখুনঃ



কোন মন্তব্য নেই

rusm থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.