ইবনে আরাবির সাথে মাওলানা রুমির সাক্ষাৎ (পর্ব-১)
এটা একটা ঐতিহাসিক বিতর্ক। ইবনে আরাবির সাথে কি মাওলানা রুমির দেখা হয়েছিলো? নাকি হয়নি? ইবনে আরাবি যখন মারা যান, তখন মাওলানা রুমির বয়স ছিলো ৩৩ বছর। তাহলে দেখা হওয়া অসম্ভব নয় নিশ্চয়। যদি দেখা হয়েই থাকে তাহলে ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই কেনো? মাওলানা রুমির লেখায় ইবনে আরাবির উপস্থিতি নেই কেনো?
এক্ষেত্রে ইতিহাসবেত্তারা বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন। একদল ঐতিহাসিক বলেছেন তাদের শুধু দেখা নয়, বরং খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। আবার কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, তাদের কখনোই দেখা হয় নি।
শৈশব থেকেই মাওলানা রুমির জীবন দ্রুতগতির মৌমাছির মতো। মৌমাছি যেমন বিভিন্ন ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে, তিনিও তেমন বিভিন্ন শহরের অজস্র জ্ঞানীদের স্নেহধন্য হয়ে জ্ঞানলাভ করেছেন। কত পন্ডিত, কত সাধকের কুটিরে মাওলানা রুমি গিয়েছেন সে হিসেব আঙুলের ডগায় হবে না। শৈশবেই তার বাবা বাহাউদ্দিন ওলাদ বলখ শহর ছেড়ে সপরিবারে নিশাপুরে চলে যান। তখন মাওলানা রুমির বয়স ছিলো মাত্র ৬ বছর (মতান্তরে ১২ বছর)। সেখানে কিছুকাল থেকে বাবার সাথে বাগদাদে যান। বাগদাদে কয়েক বছর অবস্থানের পর মক্কার দিকে রওনা হন পবিত্র হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে। হজ্জ্ব শেষ করে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে জ্ঞানলাভ করতে থাকেন পরের বছরগুলোতে। ভ্রমণের এক পর্যায়ে তিনি তখনকার জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থভুমি দামেস্কে এসে পৌঁছান। এটা বিরোধপূর্ণ একটা তথ্য যে তিনি হজ্জ্ব করার আগে দামেস্কে এসেছিলেন নাকি হজ্জ্ব করার পরে এসেছিলেন। তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা নিশ্চিত যে তিনি তখনো পূর্ণবয়স্ক হন নি। দামেস্ক এমন একটা শহর ছিলো যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে জ্ঞানচর্চা করতো। শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়, সেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কলা, স্থাপত্যবিদ্যা, মহাকাশবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জ্ঞানের সমস্ত শাখায় পড়ালেখা করার সুযোগ ছিলো। পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন। মুসলিমদের পাশাপাশি ইউরোপ থেকে আসা প্রচুর খ্রিস্টান জ্ঞানচর্চায় সমান সুযোগ পেতো। এই জ্ঞানের শহরে ইবনে আরাবির পদচারণা থাকবে না তা কিভাবে হয়!
মাওলানা রুমি যখন তার বাবার সাথে দামেস্কে এলেন, তখন ইবনে আরাবি এই শহরেই অবস্থান করছিলেন। তার বাবা বাহাউদ্দীন ওলাদ যেখানেই যেতেন সেখানকার জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। ঠিক এরকম একটা সময়ে ইবনে আরাবির সাথে বাহাউদ্দীন ওলাদের দেখা হয়। বাবার পিছনে মাওলানা রুমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে ইবনে আরাবি বলে উঠলেন, “আল্লাহর কী মহিমা! একটি হ্রদের পিছনে একটি সমুদ্র হাটছে।”
বাহাউদ্দীন ওলাদকে বলা হতো আলেমদের সুলতান। ইবনে আরাবি মাওলানা রুমিকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন যে এই ছেলেটি তার বাবার চেয়েও বড় জ্ঞানী হবেন, তার জ্ঞান বিশ্বকে আলোকিত করবে। তার মুখের দীপ্তি দেখে ভবিষ্যৎ বুঝে নিয়েছিলেন ইবনে আরাবি। এটাকে কি দেখা হওয়া বলে?
অন্যদিকে বলা যায়, সামনাসামনি দেখা না হলে কি দেখা হয় না? দেখা হওয়ার জন্য শারীরিক উপস্থিতি আসলেই জরুরী?
একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ, সৈয়দ হোসেইন নাসর বলেছেন, “বিখ্যাত সাধক জালাল-উদ্দীন রুমি অপর বিখ্যাত সাধক ইবনে আরাবির সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন সদর-আল-দ্বীনের মাধ্যমে। সদর-আল-দ্বীন উভয়ের পরিচিত এবং ভক্ত ছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইসলামের এই দুই মহান সাধকের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তবে এটাও সত্য যে ইবনে আরাবির সাথে মাওলানা রুমি সম্পর্কযুক্ত হলেও দুইজনের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। মাওলানা রুমি সুফিবাদের ভিন্ন একটা পথ বা তরীকা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা ইবনে আরাবির থেকে আসা নয়।” (উতসঃ S. H. Nasr, Sufi Essays (Albany, NY: SUNY, 1972, rep. 1991)
কিন্তু সৈয়দ হোসেইন নাসরের ছাত্র নাসরুল্লাহ পুরজাভেদি তার শিক্ষকের বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন। তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেটা গুরত্বপুর্ণ কিছু নয়। তাদের যদি দেখা হয়েও থাকে তা নিছক পরিচয় ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তাঁরা কেউ কারো দ্বারা প্রভাবিত হন নি। তাদের পথ ছিলো ভিন্ন। বরং মাওলানা রুমির সাথে বায়েজিদ বোস্তামি, মানসুর হাল্লাজ, আহমেদ গাজ্জালি, সানাই-ই এবং আত্তারের ঘরানার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলেন।” (উতসঃ Introduction to A¢mad GhazÂlµ, SawÂni¢: Inspirations from the World of Pure Spirits. Translated from the Persian with a Commentary and Notes by Nasrollah Pourjavady (London: KPI, 1986), 3, n.2.)
এরপরের পর্বগুলোয় আমরা দেখবো কিভাবে এই দুই মহান সাধকের ভেতরে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলেন সদর-আল-দ্বীন এবং তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কোথায়। শামস তাবরিজির সাথে কেমনই বা সম্পর্ক ছিলো ইবনে আরাবির।
তথ্যসূত্রঃ
১) এস খলিলুল্লাহর অনুবাদকৃত দিওয়ান-ই-শামস-ই তাবরিজির ভূমিকাংশ (ইরা ফ্রিডল্যান্ডারের ভূমিকা)
২) মাওলানা আব্দুল মজীদের অনুবাদকৃত মসনবীয়ে রুমির ভূমিকাংশ ইত্যাদি।
৩) এন্ড্রু হার্ভের "রাগমার্গ"
৪) Did the Two Oceans Meet? Connections and Disconnections
between Ibn al-°Arabµ and R¨mµ* by Omid Safi
আরও দেখুন
লেখাঃ আবু নাহিয়ান
কোন মন্তব্য নেই